রুডলফ রকারের এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও অনুশীলন - অধ্যায়ঃ চতুর্থ- এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের উদ্দেশ্য ( প্রথম অংশ)

রুডলফ রকারের এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও অনুশীলন - অধ্যায়ঃ চতুর্থ- এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের উদ্দেশ্য ( প্রথম অংশ)

ভাষান্তরঃ এ কে এম শিহাব

আধুনিক এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের উৎপত্তি হয়েছে প্রথম আন্তর্জাতিকের আকাঙ্ক্ষার ভেতর থেকে, সেই সময়ে শ্রমিক শ্রেনীর জোট ও সংগঠন যে সকল বিষয়ে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন তার ধারাবাহিকতাই এই আদর্শের জন্ম দিয়েছে। ১৯২২ সালে সেই আদর্শের আলোকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করা হয়েছিলো, যা এখনো এগিয়ে চলছে। এঁদের মধ্যে স্পেনে গঠিত কনফিডেসিওন ন্যাশনাল ডি ত্রাবোজো সব চেয়ে ক্ষমতাশালী ও প্রভাব সৃষ্টি কারী সংগঠন হিসাবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। এই সংগঠনের তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিলো মুক্তিপরায়ন সমাজবাদের দিক্ষা। সিন্ডিক্যালিজমের প্রভাব  এর উপর ও কোন অংশে কম ছিলো না । ১৯০০ সাল থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে এই সংগঠনের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। বিশেষ করে ফ্রান্সে এর প্রভাব ছিলো ব্যাপক। এটা সরাসরি রাজনৈতিক সমাজবাদের বিপরীতে অবস্থান নেয়, বিভিন্ন দেশে এটা শ্রম অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে। প্রথম আন্তর্জাতিকের সময়ে ও জার্মান, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে এই ধারা অবস্থান ছিল। আজ আমরা বিগত ষাট বছর ধরে পরিচালিত  নানা দেশে শ্রমিক আন্দোলন ও সমাজবাদের বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপের একটা মূল্যায়ন করতে পারছি।

বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রাজনীতিতে শ্রমিক শ্রেনীর অংশগ্রহণ খুব জোরালো ভাবে গ্রহন করা হয় না, কেননা তাঁরা সমাজবাদের আলোকে কথা বলেন, এই জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। এখন যদি ও সমাজবাদ  অনেকাংশে বিলিয়মান। তাঁরা বিচ্ছিন্ন ভাবে কেবল প্রতিবাদ করতে পারছেন। প্রবাদ আছে, “ যে লোক ধর্ম গুরুকে খেয়ে ফেলে, তাকে আপনি আর কি করতে পারেন”। এছাড়া ও আরো সত্য কথা হলো। যারা রাষ্ট্রের খায় পড়ে, তারাই আবার এটাকে ধ্বংস করে দেয়। সংসদীয় রাজনীতিতে শ্রমিক আন্দোলনের অংশগ্রহন অনেকটা বিষের মত প্রভাব ফেলছে নানা দেশে। গঠন মূলক সমাজবাদের উপর মানুষের বিশ্বাসকে তিরোহিত করে দিচ্ছে। এটা সকল শ্রমজিবী আন্দোলনের জন্য সর্বনাশ। এটা আত্মনির্ভরশীলতাকে বিনষ্ট করছে, তাঁদের মধ্যে এমন ধারনা সৃষ্টি করছে যে সকল শান্তি ও সমৃদ্বি আসে উপর থেকে।

সুতরাং পুরাতন আন্তর্জাতিকের সমাজবাদের স্থলে এমন এক সমাজবাদের আমদানী করা হয়েছে, যেখানে কেবল নামটি ছাড়া প্রকৃত সমাজবাদের কোন মিল নেই। সমাজবাদ ক্রমে নিজের প্রকৃত সাংস্কৃতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে, ধারনা দেয়া হয় পুঁজিবাদের সমাজে একটি সমাধান করে ফেলা যেতে পারে। নিজেদের দেশের সীমার ভেতরে থেকে প্রকৃত সামাজিক পরিবর্তন যে একেবারেই অসম্ভব তা ও ভুলিয়ে দেয়া হয়। সমাজবাদি নেতাদের মানসিকতার বদলের ফলে তাঁরা তাঁদের জাতীয় রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে থেকেই নিজেদের দলীয় কার্যক্রমের লক্ষ্য উদ্দেশ্যে ব্যাপক পরিবর্তন করতে থাকেন। তাঁরা বেমালোম ভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদ বাদ দিয়ে নিজেদের দেশের সীমায় আবদ্ব হয়ে পড়েন। এঁরা জাতীয় রাষ্ট্রের যন্ত্রে পরিণত হয়ে পড়েন। তাই শ্রমিক আন্দোলন সমূহের দায়িত্ব হলো জাতীয় রাষ্ট্রের কবল থেকে সামগ্রীক আন্দোলনকে মুক্ত করে আগের জায়গায় নিয়ে আসা । অর্থাৎ আন্দোলনকে আন্তর্জাতিকতাবাদে রূপান্তর করা।

এটা ঠিক হবে না যে, বিশ্বাস ঘাতক আন্তর্জাতিক নেতাদের মুখোশ সকলের সামনে এখনি খোলে দেয়া, তাঁরা যা করেছে তা প্রকাশ করে ফেলা। এটা সত্য যে, আমরা সব কিছুই ক্রমে বুঝে সুঝে করতে চাই, পুঁজিবাদী সমাজের চিন্তাধারার সাথে বুঝা পড়াটা ঠিক ঠাক মত চালিয়ে যেতে চাই। এখন শ্রমিক দল বাস্তবে এমন কিছু কাজই করে চলেছে। তাঁদের কর্মকান্ড বুদ্বিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তা চেতনাকে ও প্রভাবিত করে ফেলেছে । এই সমাজবাদি দল গুলো এক সময় কঠিন কঠিন সব যুক্তি নিয়ে বেড়িয়ে এসেছিলেন, তাঁরা জাতীয় রাষ্ট্র, সরকারকে নিপাত করতে বদ্বপরিকর ছিলেন। তাঁরা সেনাবাহিনীর বিরুধিতা করেন, তাঁরা জনগণকে বুঝাতেন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য জনগনই যতেস্ট, সমাজবাদই সব কিছুর রক্ষা কবচ। তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দখলে আনার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ব ছিলেন, সেখানে ক্রমে সমাজবাদ কায়েম করে সর্ব স্তরে মানুষের ক্ষমতায়ন চাইতেন।

এর পরের দৃশ্য ভিন্ন রকম, দেশে দেশে  শ্রমিক দল সমূহে সংসদীয় রাজনীতি ঝেঁকে বসল খুবই দ্রুত, ক্ষমতা লোভী নেতা/নেত্রীগন সমাজবাদের ক্ষেত্র গুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার শুরু করে দেয়। আর এই সকল পদক্ষেপ দলের ভেতরে শুরু হয় পতনের ধারা, তাঁরা ক্রমে সমাজবাদের মৌলিক নীতিমালা বর্জন করে ভিন্ন পথে হাঁটা শুরু করে দেয়। সমাজবাদ একটি সময়ে সকল প্রকার সৃজন শীলতা হারিয়ে ফেলে, সংস্কারের পথ ধরে শুভেচ্ছা আকাংখীতে পরিণত হয়। লোকেরা ভোটে জয় লাভ করার মধ্যেই নিজেদের আনন্দ খোঁজে নেয়, নয়া সমাজ বিনির্মানের লক্ষ্যে যে পথ চলা শুরু হয়েছিল, শ্রমিক শ্রেনীর রাজনীতির যে শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো তাঁরা তা বর্জন করে ফেলে। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় কেবল মাত্র চলমান সমস্যার প্রতি উপেক্ষা আর সমাজবাদকে সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে না পারার কারনে । অথচ সেই সময়ে দুনিয়া জুড়ে একটি বিপ্লবী পরিবেশ উদ্ভব হয়েছিলো, প্রথম বিশ্ব যুদ্ব কালিন সময়ে ইউরূপের অনেক দেশেই তখন বিপ্লবের জন্য উন্মূখ ছিলো। দেশে দেশে তখন পুরাতন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, সমাজবাদি চিন্তাধারা তখন খুবই জনপ্রিয় শ্লোগান। কিন্তু সমস্যা ছিলো অনেকেই সমাজবাদের সত্যিকার মর্ম বুঝতেন না। রাশিয়াতে রাস্ট্রবাদি সমাজবাদিগন ক্ষমতা দখল করে, ফলে বলশেভিকদের রাস্তা প্রসারিত হয়, তাঁদের লক্ষ্য সমাজবাদি সমাজ বিনির্মান ছিলো বলে কখনই মনে হয় নাই। বরং তাঁদের মাঝে পুরনো ধারার আমলাতান্ত্রিকতা অনুসরন করাই লক্ষ্য হয়ে উঠে। তাঁরা রাস্ট্রীয় পুঁজিবাদ, একনায়কতন্ত্রকে বিকাশ ঘটায় । যা ইতিমধ্যে অনেক দেশে বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে তিরোহিত হয়ে গিয়েছিলো। জার্মানীতে মধ্যপন্থী সামাজিকগনতন্ত্রীরা ক্ষমতায় আসে। সেখানে দির্ঘকাল যাবত  সমাজবাদ পার্লাম্যান্টারী পদ্বতী হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছিলো। এটা এতই অকেজো হয়ে পড়ে যে তা আর কোন প্রকার সৃজন কাজ করা ক্ষমতাই ধরে রাখতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে ফ্রাংফ্রোটের জিতং বুর্জোয়া গনতান্ত্রিক লোকেরা ও বলতে থাকেন যে, “ ইউরূপ পূর্বে বিপ্লবের অনেক কাজ করেছে কিন্তু এখন এত দূর্বল হয়ে পড়েছে যে, তাঁদের পক্ষে কোন প্রকার সৃজনশীল কাজ আর করা সম্ভব হচ্ছে না”।

কিন্তু এখানে শেষ নয়ঃ রাজনৈতিক ভাবে সমাজবাদ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়ায় যে, তাদের পক্ষে গঠন মূলক সমতাবাদি চিন্তার লালন করা ও দুরূহ হয়ে পড়ে।   নৈতিক ভাবে ও এমন অবস্থায় উপনিত হয় যে, তাঁদের পক্ষে বুর্জোয়া গণতন্ত্র, স্বাধিকার রক্ষা করা এমন কি নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষার জন্য ও ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নিতে হয়  তাঁদের। শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলন সংগ্রামকে উপর্যোপরি আঘাত করে দমন করে রাখে। এই অবস্থা দেখে বুর্জোয়া রাষ্ট্র গুলো ও অবাক হয়ে দেখে যে, সমাজবাদ একটি অথর্ব ও অকার্যকর মতবাদে পরিণত হয়েছে। এটা যেন  টেবিলে শিকল দিয়ে বাঁধা একটি কৃতদাস।

আধুনিক এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম হলো রাজনৈতিক সমাজবাদের একটি সরাসরি বিপরীত ধারার মতবাদ। এই বিপরীত ধারার মতবাদটি বিকশিত হবার জন্য লড়াই করছে ফ্রান্সের, ইতালী, এবং অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের মাঝে সিন্ডিক্যালিজমের  আন্দোলন দানা বাঁধার পর থেকে। আর সেই আন্দোলনের উৎস ছিলো প্রথম আন্তর্জাতিকের মুলমন্ত্র। শ্রমিক গন সেই মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে লড়াই সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলো।

“ শ্রমিক’ সিন্ডিকেট” শব্দটি ফরাসি শব্দ এর অর্থ হলো- ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা। যার তাৎক্ষনিক লক্ষ্য হলো শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা। কিন্তু এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম বিকশিত হবার পর এর অর্থগত ও কর্মপরিসর আরো প্রসারিত হয়। এই ধারার কাজে সংযুক্ত সংগঠন সমূহ আধুনিক রাজনৈতিক, সাংবিধানিক রাষ্ট্র সমূহে চলমান বুর্জোয়া বিধি বিধানের আমূল পরিবর্তন করে, নতুন ধারা প্রবর্তন করতে চায়। তাই সিন্ডিক্যালিজমের মতে, ট্রেড ইউনিয়ন, সিন্ডিকেট সমূহ এবং শ্রমিক সংগঠন গুলি পন্য পয়দা কারীদের সামগ্রীক স্বার্থ সুরক্ষার জন্য সামাজিক পরিবর্তন সাধন করতে চায়। প্রচলিত সমাজ কাঠামো বদল করে সমাজবাদের ভিত্তিতে নয়া সমাজ প্রস্তুত করতে চায়। তাই এটা দুইটি লক্ষ্য রয়েছেঃ (১) শ্রমিকগন নিয়োগ কর্তাদের বিরুদ্বে লড়াই করবে নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করার জন্য। যেন তাঁদের জীবন যাত্রার মান আরো উন্নত হয়। (২) শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে বুদ্বিবৃত্তিক প্রশিক্ষন প্রদান করবে যেন তাঁরা সামগ্রীক ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ও অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য নিজেদেরকে তৈরী করতে পারেন। বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হলে যেন নিজেদের হাতে ক্ষমতা গ্রহন করে সমাজবাদের আলোকে সমাজ বিনির্মান ও পরিচালনা করতে পারেন।

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম মনে করে, রাজনৈতিক দল সমূহ এমন কি যারা সমাজবাদের নাম ধারন করে, তাঁরা উক্ত দুটি কাজ সম্পাদন করতে পারে না । এমন কি যে সকল দেশে সমাজবাদি দল সমূহ নিজেদেরকে শক্তিশালী দল বলে প্রাচার করে ও মিলিয়ন ভোট পাওয়ার জন্য ভোটারের পিছনে লেগে থাকে । শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়নের সাথে কোনও সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতেন না কারণ আইন তাদের দৈনিক রুটির জন্য তাদের সংগ্রামে কোন প্রকার সুরক্ষা প্রদান করেনি,  এটা প্রমানিত সত্য। এটা প্রায়শই ঘটেছে যে দেশের এইসব ক্ষেত্রে যেখানে সমাজতান্ত্রিক দলগুলি সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল শ্রমিকদের মজুরি সেখানে সর্বনিম্ন এবং শ্রমের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ,  ফ্রান্সের উত্তর শিল্পকেন্দ্রগুলিতে, যেখানে সমাজবাদিরা বহুসংখ্যক শহর প্রশাসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং স্যাক্সনি ও সিলেসিয়াতে, যেখানে তাদের বিদ্যমান অস্তিত্বের মধ্যে ও জার্মান সমাজতন্ত্রের নিম্নলিখিত দিকগুলি আমরা দেখতে পাই।

সরকার ও সংসদ নিজেদের উদ্যোগে অর্থনৈতিক বা সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে খুব কমই সিদ্ধান্ত নেয় এবং যেখানে এইরকম ঘটনা ঘটেছে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সত্যিকার উন্নতির কথা সবসময়ই একটি মৃত অক্ষরে পরিণত হয়েছে।এভাবে বড় শিল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজ সংসদের প্রচলিত প্রচেষ্টায়, যখন আইন পরিষদ শিশুদের ক্ষতিকারক অবস্থার প্রভাব থেকে রক্ষা করতে চেয়ে ছিলো, তখন এই দীর্ঘস্থায়ী সংকট নিরসনে দীর্ঘদিনের সমস্যাটির উপর এর কোনও প্রভাব ই ফেলতে পারে নাই।একদিকে তারা নিজেদের শ্রমিকদেরকে বুঝতে না পারার কারণে পিছু হটে, অন্যদিকে তারা নিয়োগকর্তাদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাক্ষাত হয়। ইতালির সরকার ৯০ এর দশকে আইনপরিষদ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সাথে একই রকম আচরণ করেছিল। নারীদের নিষিদ্ধ করার জন্য সিসিলিতে স্যাল্ফার খনিতে তাদের সন্তানদের কড়াকড়ি ভাবে নিয়োগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
এই আইনটিও একটি মৃত অক্ষরমালা ছিল মাত্র, কারণ এই দুর্ভাগা নারীরা এতটা কস্টকর ভাবে অর্থ প্রাদান করেছিল যে তারা আইন উপেক্ষা করতে বাধ্য হয়ে ছিলো । একটি নির্দিস্ট সময়ের শেষে, যখন এই কর্মরত নারী্রা সংগঠন করতে সফল হয়েছেন, এবং এইভাবে তাদের জীবনযাত্রার ও মানসিকতা উন্নতি হয়েছে, তখন মন্দ দিক গুলো নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রত্যেক দেশের ইতিহাসে এমন অনেকগুলি দৃষ্টান্ত রয়েছে।

এমন কি সংস্কারের ও আইনী  অনুমোদনের কোন নিশ্চয়তা নেই। যদি জাগ্ররত জনতার চাপ না থাকে বা লড়াকো মানসিকতা নিয়ে সংসদের বাহিরে জনগণ অবস্থান না নেয় তবে আইন জনতার পক্ষে আসেনা । ১৮৮৪ সালে এই ভাবে ফ্যাক্টরী মালিকেরা একটি আইন করিয়ে নিয়েছিলো যাতে ১০ ঘণ্টা কাজ করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই আইনের সুবাদে তাঁরা শিল্প সঙ্কটের কথা বলে শ্রমিকদেরকে দিয়ে এগার বার ঘণ্টা কাজ করিয়ে নিত। কিন্তু যখন ফ্যাক্টরী পরিদর্শকগন এই কাজ পরিদর্শন করে যখন কোন আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করতে চাইতেন তখন অভিযুক্তরা নির্দোষ প্রমানিত হত। অধিকন্ত সরকার পরিদর্শদেরকে নির্দেশনা দিতেন তাঁরা যেন আক্ষরিক অর্থে আইন প্রয়োগ না করেন । এই ভাবে শ্রমিকদের উপর কাজ চাপিয়ে দেয়া সহজতর হত। ফলে শ্রমিকদের আবার দশ ঘণ্টা কাজের জন্য মাঠে নামতে হয়। ১৯১৮ সালে জার্মান শ্রমিকগন ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে নভেম্ভর বিপ্লব সাধন করে, অন্যদিকে সেখানে ইতিমধ্যে তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সাধিত হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের নিকট থেকে তা নিয়োগ কর্তারা ছিনিয়ে নেয়। যা ছিলো সম্পূর্ন বে আইনী ও জগন্যতম অন্যায়।

আদতে রাজনৈতিক দল গুলো প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনীর জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে তেমন কোন ভূমিকাই রাখতে পারে না। তাই তাঁরা একটি সমাজবাদি সমাজ বিনির্মান করে দিবেন এটা কল্পনা বিলাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন কি তার জন্য কোন প্রকার অবাদান রাখা ও তাঁদের জন্য অসম্ভব। মূলত এই ধরনের কাজের জন্য এঁদের জন্মই হয় নাই।  রাশিয়া ও জার্মানীতে এর প্রচুর উদাহন বিদ্যমান আছে ।

শ্রমিক আন্দোলন শুরু করতে হবে, কোন রাজনৈতিক দল নয়, সমাজবাদি চেতনা ধারন করে দৈনিন্দিন সমস্যার সমাধান করার জন্য কাজ করতে হবে। কেবল অর্থনৈতিক পরিমন্ডলেই শ্রমিকগন নিজেদের সামাজিক শক্তির উত্থান ঘটাতে পারেন। পন্য উৎপাদন কারী হিসাবে নিজেদের মাঝে ঐক্য গড়া ও সামাজিক কাঠামো বিনির্মান করতে পারেন । কর্ম ক্ষেত্রেই শ্রমিকগন স্বাভাবিক জীবন অনুভব করতে পারেন। অন্য জায়গায় লড়াই সংগ্রামে যুক্ত হলে এঁরা নিজেদেরকে বহিরাগত মনে করেন, তাঁদের আশা আকাংখার প্রতিফলন দেখতে পায় না । নিজেরা আশাহত হন বা তাঁদের লক্ষ্য অর্জনের কোন সম্ভাবনাই তাঁরা দেখেন না । ফলে নিরাশা আর নিস্কৃয়তা ভর করে তাঁদের জীবন জুড়ে।

সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে শ্রমিকটি গ্রীক কিংবদন্তি অ্যান্টিয়াসের মতো, যাকে হারকিউলিস তার মাকে পৃথিবী থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার পরে গলা কেটে ফেলতে সক্ষম হন। শুধুমাত্র সামাজিক সম্পদ সৃষ্টিকারী এবং পন্য সৃষ্টিকর্তা হিসাবে তিনি তার শক্তি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন; তার সঙ্গীদের সাথে একাত্মতাবাদী সংগঠনে তিনি ট্রেড ইউনিয়নে অজৈব ফালানক্স তৈরি করেন যা কোনও আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে পারে, এটি যদি স্বাধীনতার চেতনা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার আদর্শের দ্বারা প্রাণবন্ত ও উজ্জীবিত হয়।

এনার্কো-সিডিকা্লিস্টদের জন্য ট্রেড ইউনিয়নের অর্থ কোন পুঁজিবাদী সমাজের সময়কালের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা একটি প্রান্তিক ঘটনা নয়। এটি ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক সমাজের সাধারণ চেতনা বা  সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রত্যেক নতুন সামাজিক কাঠামো নিজের জন্য প্রাচীন সমাজের দেহে নিজের ব্রুন তৈরী করে। এই প্রাথমিক ব্রুন ছাড়া কোন সামাজিক বিবর্তন অসম্ভব। আসল কথা হল, কাংখিত বিপ্লব কেবল মাত্র বর্তমানে বিদ্যমান যে সমাজ রয়েছে সেখানে এর চেতনার বিকাশ ও পরিপক্ক হতে হবে এবং লোকদের  মধ্যে তাদের সচেতনতার পথ তৈরি করতে হবে ; তারা নিজেরা এই গুলি তৈরি করতে পারে না বা নতুন জগতে সৃষ্টি করতে পারে না। তাই আমাদের এই চেতনা গুলি বিকশিত করার জন্য উদ্দীপ্ত করার এখনও সময় আছে এবং তাদেরকে শক্তিশালী করতে হবে।  এমন এক স্তরে  বিকাশিত করতে  হবে যাতে করে তা আসছে সামাজিক বিপ্লবের  কাজ সহজ করতে ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে।

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের সকল শিক্ষা ও প্রশিক্ষন সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হতে হবে । সমাজবাদের জন্য শিক্ষা- এর মানেই নয় যে তা প্রচলিত রাজনৈতিক প্রচারনার মতই হবে। বরং পন্য পয়দাকারী লোকদেরকে বুঝতে হবে যে এই সমাজের প্রকৃত, কৌশলগত ও পরিচালনাগত সমস্যা কি কি । তাঁদের নিজেদের জন্য কি কি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থার পুর্গঠনের জন্য এবং তার পরিচালনার জন্য কারনীয় কি কি তাও বুঝতে হবে । শ্রমিকদের অর্থনৈতিক লড়াই সংগ্রামের জন্য  আর কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন উপযুক্ত নয়; এটাই শ্রমিক শ্রেনীর মানুষের জন্য জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে । প্রচলিত ব্যবস্থায় অন্যান্য দলের সমর্থকে পরিণত হলে বা কাজ করলে তাঁদের মধ্যে কোন প্রকার নৈতিক বা সামাজিক রূপান্তর অসম্ভব। কেউ তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করলে বা অনুসারী হলে তাদেরকে নিজে কাজ কর্ম দিয়ে প্রমান করতে হবে যে তাঁরা শ্রমিক বান্দ্বব।

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের সকল শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের লক্ষ্য হলো মানুষকে স্বাধীন কর্ম ও চিন্তার দিকে অগ্রসর করা । তাঁরা যেন সকল প্রকার কেন্দ্রীকতা ও রাজনৈতিক শ্রমিক দলের বিরুধীতা করতে পারেন। কিন্তু কেন্দ্রীকতাবাদ কৃত্তিম ভাবে সংগঠিত প্রক্রিয়ায় সকলের উপর  সংখ্যা লগুদের একটি অদৃশ্য বলয় সৃজন করে থাকে। একটি প্রানহীন কর্মসূচী দিয়ে কাজ করার প্রায়স চালায়; এই সকল প্রক্রিয়া সকলের ব্যাক্তিগত উদ্যোগকে বিনাশ করে দেয়, এবং একটি প্রানহীন শৃংখলার নামে মানুষের উপর আমলাতান্ত্রিকতা ঝেঁকে বসে। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের সংগঠন ফেডারেশন ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, এখানে নিচের দিক থেকে উপরের দিকে স্বাধীন মতামতের গুরুত্ব প্রাধান্য পায়, প্রতিটি সদস্য তাঁদের নিজস্ব সিদ্বান্ত গ্রহনের ক্ষমতা লালন করতে পারেন, সম্মিলিত সিদ্বান্তের প্রতি ঐক্যমত গ্রহন ও ভিন্নমত পোষনের সুযোগ দেয়া হয়।

প্রায়স ফেডারেলিজমের বিরুদ্বে একটা অভিযোগ করা হয় যে, এটা মানুষের মাঝে বিভক্তি আনে আর সংগঠিত প্রতিরোধ সংঠনের ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করে দেয়। এবং বলায় হয় এটা রাজনৈতিক শ্রমিক দলের প্রতিনিধি এবং তাঁদের প্রভাবাধীন ট্রেড ইউনিয়নের মতই কাজ করে- আসলে এই ধরনের অভিযোগ মুখস্থ বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এখানে ও জীবনের কঠিন আসল সত্য ও বাস্তবতা প্রকাশিত হয়েছে। সকল সময়েই তত্ত্বের চেয়ে জীবন অনেক মূল্যবান । এখন পর্যন্ত দুনিয়ায় এমন কোন দেশ নেই যেখানে সকল শ্রমিক আন্দোলন কোন না কোন ভাবে নিজেদের ঐক্য নিখুত ভাবে গড়ে তুলতে পেরেছে। কেবল জার্মানীতে হিটলার শ্রমিক সংস্থাকে যুগান্তকারী উদাহরন সৃষ্টি করে নিজেদেরকে দৃঢ় কঠিন ঐক্যে আবদ্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তিনি সারা দেশকে একটি আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় এনে সকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মের নেতৃত্ব দিয়েছেন । সাম্প্রতিক নির্বাচনে সামাজিক গনতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় বার মিলিয়ন ভোটার তাঁদের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করেন । এই নির্বাচনের পর হিটলার ক্ষমতায় এসে যখন মানবজাতির জন্য এক মহা বিপর্যয় সৃষ্টি করল তখন ছয় মিলিয়ন শ্রমিকের কেহই একটি অংগুল তুলে এর প্রতিবাদ করেনি। অল্প সময়ের মধ্যেই হিটালার শ্রমিকদের সকল সংগঠন টুকরো টুকরো করে ফেলে।

কিন্তু স্পেনে কি ঘটল, প্রথম আন্তর্জাতিকের পর থেকেই সেখানে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে উঠেছিলো। তাঁরা সেখানে মুক্তিপরায়ন ও প্রতিরোধ মূলক চিন্তা ধারার প্রচারনা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষন দিচ্ছিলো। সেখানে যে সংগঠন টি শক্তিশালী  অবস্থানে ছিলো তা হলো সি এন টি। তাঁরা ফ্রাঙ্কো ও তার দেশীয় ও বিদেশী দালাল চক্রের বিরুদ্বে প্রথম থেকে অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে । সিন্ডিক্যালিস্টগন তাঁদের বীরোচিত ভূমিকার মাধ্যমে স্পেনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্বে লড়াই ছালিয়ে যায়।ফ্রাঙ্কোর প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্বে তাঁরা শক্ত অবস্থান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতির কথা ফ্রাঙ্কো নিজেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো। এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন প্রতিরোধ গড়ে না তুললে কয়েক দিনের মধ্যেই ফ্রাংকো সমগ্র স্পেনের উপর প্রভূত্ব কায়েম করে ফেলত।

যখন একজন ব্যাক্তি সি.এন.টি. এর ফেডারেল সংগঠনের কৌশলটি তুলনা করেন। জার্মান শ্রমিকরা নিজেদের জন্য  কেন্দ্রীয় সহায়তার মাধ্যমে সংগঠন গড়ে তুলেন। এঁদের প্রাক্তন সাথীদের  সরলতা দেখে কেউ কেউ অবাক হন। ছোট সিন্ডিকেট সংগঠনের প্রতিটি কাজ স্বেচ্ছায় সম্পাদিত হয়। বৃহত্তর সাংগঠনিক পরিসরে, যেখানে স্বাভাবিকভাবেই আনুষ্ঠানিকভাবে  নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন হয়,  সেখানে এক বছরের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে থাকে এবং তাঁরা তাদের কাজের জন্য পারিশ্রমিক হিসাবে একই বেতন পেয়ে  থাকেন। এমনকি সি.এন.টি. এর সাধারণ সম্পাদক ও তাই পান। এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম ছিল না। এটি একটি পুরানো ঐতিহ্য যা আন্তর্জাতিকের সময় থেকে  এখন পর্যন্ত স্পেন চালু রাখা হয়েছে । এই সাধারণ সংগঠনটি শুধুমাত্র স্প্যানিশ শ্রমিকদের C.N.T. এটাই প্রথম লড়াই সংগ্রামে একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্র, এটা তাদেরকে আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়  নিজেদের রক্ষাকারী হিসাবে ঠিকিয়ে রাখে এবং এই সংগঠনটি  চরিত্রগত ভাবে একাত্মতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে তাদের সাহায্য করে এবং তাঁরা অন্য কোন দেশের সাথে মিলিত হয নাই।

রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীকরণের জন্য সংগঠনই উপযুক্ত কাঠামো, এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য সামাজিক জীবনে সর্বাধিক সম্ভাব্য  সামঞ্জস্য বজায় রাখার বিষয়টির প্রতি  লক্ষ্য রাখে। কিন্তু একটি আন্দোলনের জন্য যখন কোনও অনুকূল মুহূর্তে অবিলম্বে পদক্ষেপের  দরকার হয়ে পড়ে এবং তখন তার সমর্থকদের স্বাধীন চিন্তা ও কর্মের  শক্তির উপর নির্ভর করা জরুরী হয়ে পড়ে, তখন কেন্দ্রীকরণটি তার সিদ্ধান্তের শক্তিকে দুর্বল করে এবং সমস্ত তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি  পরিচালনা করতে সমস্যা  হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির  কথা  উল্লেখ করতে হয়।  প্রত্যেক স্থানীয় ধর্মঘট পালনের ক্ষেত্রে  কেন্দ্রীয়  অনুমোদন দরকরা হত, যা প্রায়শ শত মিলিয়ন মাইল দূরে ছিল এবং সাধারণত স্থানীয় অবস্থার উপর একটি সঠিক সিদ্বান্ত গ্রহন করার মতো অবস্থানে ছিল না। আশ্চর্যের কিছু নেই যে সংগঠনের যন্ত্রপাতির অদলবদল একটি দ্রুত আক্রমণকে অসম্ভব করে তুলেছে এবং এভাবে সেখানে একটি রাষ্ট্রীয় বিষয় উঠে আসে যেখানে শক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সতর্ককারী গোষ্ঠীগুলি এখন আর কম সক্রিয় করার জন্য নিদর্শন হিসেবে কাজ করে না, তবে এই সকল বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা  মাধ্যমে নিন্দা করা হয়, নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন সংগ্রামে  নিস্কৃয়তা,  ও সব কিছু বন্দ্ব করে দেয়া একটি উপায়। যখন এটি নিজেই শেষ হয়ে যায়, তখন এটি তার সদস্যদের চিন্তা চেতনা ও উদ্যমকে হত্যা  করে ফেলে এবং মধ্যবিত্তের দ্বারা এই সংগঠনে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে যা সমস্ত আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য।

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম হলো এমন একটি মতবাদ যা ট্রেড ইউনিয়নকে এমন ভাবে তৈরী করতে চায় যা শ্রমিক শ্রেনীর আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারন করে তাঁদের নিয়োগ কারীদের বিপরীতে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এবং সাথে সাথে নিজেদেরকে এমন ভাবে তৈরি করবে যাতে শ্রমিকগন সামাজিক বিপ্লব সাধন করে নয়া ধরনের সমাজ বিনির্মানে সক্ষম হয়ে উঠবেন । নয়া  সামাজিক জীবনের এঁরা হবে  অনুঘটক। শ্রমিকদের সংগঠনে যথাযথভাবে নিম্নোক্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়: প্রতিটি এলাকায় শ্রমিকরা তাদের নিজ নিজ কাজের জন্য ইউনিয়নগুলিতে যোগদান করেন এবং এটিতে কোনও কেন্দ্রীয় ভেটো প্রয়োগ করে না বরং স্ব-সংকল্পের সম্পূর্ণ অধিকার ভোগ করে। একটি শহর বা গ্রামীণ জেলায় ট্রেড ইউনিয়ন একটি শ্রম অঞ্চলে  একত্রিত হবে। শ্রম অঞ্চল গুলি স্থানীয় প্রচার ও শিক্ষার জন্য কেন্দ্র গঠন করে; তারা একসঙ্গে শ্রমিকদের একত্রে জড়ো করে এবং কোন সংকীর্ণ মনস্তাত্ত্বিকতার চেতনা গড়ে তোলার প্রতিরোধ করে। স্থানীয় শ্রম সংকটের সময়ে তারা পরিস্থিতির অধীনে  প্রতিটি সংস্থা ব্যবহারে সংগঠিত শ্রম শক্তির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্বির  ব্যবস্থা করে। সমস্ত শ্রম আঞ্চলিক শাখা গুলি জেলা অঞ্চলে ন্যস্ত করে জাতীয় ফেডারেশন অব লেবার কার্টেল গঠন করে, যা স্থানীয় সংস্থাগুলির মধ্যে স্থায়ী সংযোগ বজায় রাখে, বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের সহকর্মী লাইনের উৎপাদনশীল শ্রম শক্তির স্বাধীন সমন্বয় করার ব্যবস্থা করে।  শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে, যার মধ্যে শক্তিশালী কার্টেলগুলিকে দুর্বলদের সহায়তায় আসতে হবে, এবং সাধারণ পরিষদ এবং নির্দেশিকা সহকারে স্থানীয় দলকে সহায়তা করবে।

প্রতিটি ট্রেড ইউনিয়ন,  সমবায় সমিতি, একটি ট্রেড ইউনিয়নের জোটে সমস্ত দেশের সাথে জড়িত হবে, এবং এইগুলির সব  পারস্পরিক ভাবে সম্পর্কিত থাকবে, যাতে সমস্ত সাধারণ শিল্প সমিতির মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে পারে। স্থানীয় সংগঠন সমূহের মধ্যে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই জোটের কাজ এবং প্রয়োজনীয় মূলধন তৈরির জন্য উদ্যোগ গ্রহন করবে। মূলধন ও শ্রমের মধ্যকার দির্ঘ কালের যে সংগ্রাম চলছে তা দূরীকরনের জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহন করবে। সুতরাং ফেডারেশন অব লেবার কার্টেলস এবং ফেডারেশন অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালায়েন্স দুটি পক্ষ গঠন করবে, যার ফলে ট্রেড ইউনিয়নের সমগ্র চাহিদা পূরনে সামগ্রীক ব্যবস্থা গ্রহন করবে।

সংগঠনের এই ধরনের একটি কর্মের ধরন কেবল কর্মীদের প্রতিদিনের রুটির জন্য  সংগ্রামে সরাসরি কাজ করার  সুযোগ দেয় না, বরং এটি তাদের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনায় সমাজের পুনর্গঠন করতে বাহিরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রয়োজনীয় রূপান্তরের সুযোগ প্রদান করে থাকে। কোন একটি বিপ্লবী সঙ্কটের ক্ষেত্রে এনার্কো-সিন্ডিক্যালস্টরা বিশ্বাস করে যে, একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সরকার কর্তৃক প্রণীত আইন-কানুন দ্বারা তৈরি করা যায় না, তবে উৎপাদনকারী প্রতিটি শাখায় হাতে কলমে বা চিন্তাধারায় শ্রমিকদের অংশগ্রহনে বা একান্ত সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান আসতে পারে; যে সমস্ত  উদ্যোগ  দ্বারা এই ধরনের কর্মের মধ্যমে সমগ্র   এলাকায় বিপ্লব পরিচালনার উপর নিয়ন্ত্রন গ্রহণের দরকার হয় সেই ক্ষেত্রে  শিল্প কারখানায় পৃথক দল ও শাখাগুলিতে সাধারণ অর্থনৈতিক জীবনে স্বাধীন সদস্য এবং পদ্ধতিগতভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহন  করে এবং উৎপাদিত পণ্যগুলির বিতরণ মুক্ত ও স্বাধীন পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে সমাজের স্বার্থে ব্যবহার বা উপভোগ করা হয়।

এই পরিস্থিতিতে শ্রম কার্টেলগুলি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের বিদ্যমান সামাজিক পুঁজিটি গ্রহণ করবে, তাদের জেলার অধিবাসীদের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করবে এবং স্থানীয় অধিবেশন  অনুস্টান করবে। জাতীয় ফেডারেশন অফ লেবার কার্টেলস এর সংস্থা্র মাধ্যমে দেশের মোট প্রয়োজনীয়তা পরিমাপ করা এবং  সেই অনুযায়ী উৎপাদন কর্ম সম্পাদন ও সমন্বয় করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, উত্পাদন, যন্ত্র, কাঁচামাল, পরিবহণের মাধ্যম এবং অনুরূপ সকল উপকরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আলাদা উৎপাদনকারী দলগুলি সরবরাহ করার জন্য এটি শিল্প সহায়ক গোষ্ঠীর কাজ  করবে। সংক্ষেপে বললেঃ ১। কারখানায় উৎপাদন হবে নিজেদের দ্বারা এবং তাদের দ্বারা নির্বাচিত শ্রম কাউন্সিলের দ্বারা পরিচালিত হবেন সকলেই ২।  দেশের সমগ্র উৎপাদন সম্পন্ন হবে শিল্প ও কৃষি জোট দ্বারা । ৩। শ্রম কার্টেলস দ্বারা  সম্পন্ন হবে সামগ্রীক খরচ ও ভোগ ।

বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সত্যিকার শিক্ষা দেয়। এটা আমাদেকে শিক্ষা দেয় যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সমস্যার সত্যিকার সমাধান কোন সরকারের পক্ষে সম্পাদন করা সম্ভব নয়।  এমন কি পুরোমাত্রায় প্রলেতারিয়েতদের জন্য একনায়কতন্ত্র কায়েম করে ও তা করা অসম্ভব ব্যাপার। পার্টি রাশিয়াতে অর্থনৈতিক সংকট সৃস্টির আগেই প্রথম দুই বছরেই অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে একের পর এক ডিক্রি জারি করে তার সমাধানের চেষ্টা করা হয়। এই সকল ডিক্রির বেশীর ভাগই বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। যদি দুনিয়াকে আইনের মাধ্যমে সমস্যা মুক্ত করা যেত তবে রাশিয়াতে  কোন সমস্যার অস্থিত্ব থাকত না । সরকার গুড়ামীপূর্ন অযৌক্তিক সিদ্বান্ত গ্রহনের মাধ্যমে বলসেভিক সহিংসতা দিয়ে জোর করে স্থানীয় পর্যায়ে যে সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিলো তা ধবংস করে দেয়। সমবায়কে সঙ্কুচিত করে দেয়, ট্রেড ইউনিয়ন সমূহকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা হয়, সৌভিয়েত সমূহকে নিস্ক্রিয় করে দেয় । সূচনাতেই তাঁদের সকল প্রকার স্বাধীনতাকে খর্ব করে দেয় রাস্ট্র। চিন্তক ক্রপতকিন ন্যায় বিচারের আলোকে বলেন, “ এটা ছিলো পশ্চিম ইউরূপের দেশ সমূহের শ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ বার্তা”।

“ রাশিয়া যে উদাহরন দেখিয়েছে তাতে সমাজবাদ বুঝা মুশকিল, যদি ও জনগণ কোন প্রকার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু জনগন পুরাতন শাসন ব্যবস্থার জায়গায় এমন বিরক্তিকর প্রশাসন চায়নি। শ্রমিক কাউন্সিলের  ধারনাটি রাজনৈতিক অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রনের জন্য ছিলো একটি ব্যাতিক্রম ধর্মী উদ্যোগ। কিন্তু দেশে চালু করা হলো পার্টির একনায়কত্ব। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিক ও কৃষক পরিষদ সমূহ নিজেদের সক্রিয় ভূমিকা হারিয়ে ফেলে। ফলে এঁরা আবার সেই পুরাতন রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতই উপেক্ষিত ও নিস্কৃয় ভূমিকায় চলে যায়। শ্রমিক কাউন্সিল স্বাধীনভাবে যে উপদেশকের ভূমিকা রাখার কথা ছিলো তা আর সম্ভব ছিলো না, এমনকি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম ও বিনষ্ট করে দেয়া হয়। প্রথম দুই বছরেই এই সকল পদক্ষেপ নিয়ে নয়া ব্যবস্থার পরিবর্তে পুরাতন ধারায় যাত্রা করে কমিউনিস্ট  পার্টি। পরিস্থিতি এত খারাপের দিকে গেল যে, শ্রমিক ও কৃষক পরিষদ জনগণের নিকটে যাবার অধিকার পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল, ফলে নির্বাচনে একনায়ক পার্টির সিদ্বান্তের বাহিরে গিয়ে তাঁদের কিছুই করার ছিলো না । এই ভাবে একটি সরকার কাউন্সিল (সৌভিয়েত সরকার) দ্বারা নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রমে পেছনের দিকে যাত্রা শুরু করে। নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহনের বদলে বিপ্লব পূর্ব পুরাতন ব্যবস্থা কায়েমের ডিকে এগিয়ে যায়; যা ছিলো মূলত অচল ভিত্তির উপর দাড়িয়ে অচল নীতির চর্চা করা”।


Share Tweet Send
0 Comments
Loading...
You've successfully subscribed to Bangladesh ASF
Great! Next, complete checkout for full access to Bangladesh ASF
Welcome back! You've successfully signed in
Success! Your account is fully activated, you now have access to all content.